ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় অপরাধ দমনে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য অনুদানের ১০ কোটি টাকার কোনো কার্যকর ব্যবহার হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে খোদ ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে।জানা যায়, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারকে কেরানীগঞ্জের অপরাধ কমাতে ২০০ সিসি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপ ১০ কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করে ২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর। তৎকালীন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ওই চেক গ্রহণ করেন। ওই অনুষ্ঠানে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, পুলিশের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সাবেক কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ, বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সেক্রেটারি ও নির্বাহী পরিচালক মাকসুদুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন ।
স্থানীয়দের অভিযোগ—চেক হস্তান্তরের পর আর কখনো সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। তারা দাবি করেন, ওই ১০ কোটি টাকার পুরোটাই হস্তান্তর করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক একাধিক কর্মকর্তা জানান, চেক গ্রহণের পর ‘ঢাকা জেলা সিসি ক্যামেরা স্থাপন’ নামে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে দুটি আলাদা অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সেখান থেকে আট কোটি টাকা উত্তোলন করে এফডিআর করা হয়। ২০২৪ সালে স্থাপনা সংস্কার ও পরামর্শক নিয়োগ বাবদ ২২ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়—এর মধ্যে ১৪ লাখ টাকা আসে এফডিআরের মুনাফা থেকে এবং আট লাখ টাকা সিসি ক্যামেরা ফান্ড থেকে।
৫ আগস্টের পর তৎকালীন পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামানকে বদলি করা হলে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের দায়িত্বে আসেন আহমেদ মুয়ীদ। পরে আহমেদ মুয়ীদের পদোন্নতিজনিত বদলি হলে তিনি দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন বর্তমান পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামানকে। পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান দায়িত্ব নেওয়ার পর সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ওই টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে রেকার রশিদ ছাপানো, ঘুস কেলেঙ্কারি ও বদলিবাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ১৯৯৮ সালে বিএ ও ২০০১ সালে এমএ পাস করেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সদস্য মাহফুজুর রহমানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর মাধ্যমে বিপুল অর্থের বিনিময়ে ২৫তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়ে চাকরিতে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ উত্তরার এডিসি, ঢাকা হাইওয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল এসপি, নোয়াখালী পুলিশ ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের এসপি এবং ২০২৪ সালে রাজশাহী জেলার এসপি হিসেবে চাকরি করছেন। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে বদলিবাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে।
বদলিবাণিজ্য ছাড়াও ঢাকা পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে রেকার রশিদ ছাপিয়ে ত্রুটিপূর্ণ গাড়িকে টিআই প্রশাসন (উত্তর) সরোয়ারের মাধ্যমে মামলার ভয় দেখিয়ে রেকার বিল আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দূরপাল্লার যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা না দেওয়ার শর্তে রফিক নামে এক দালালের মাধ্যমে গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে টিআই জুলহাসের মাধ্যমে মাসে সাড়ে ছয় লাখ টাকা উঠানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ কারণে ঢাকা জেলায় অবৈধ যানবাহন বা ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা এবং সরকারি খাতে জরিমানার টাকা জমার হার তুলনামূলকভাবে কমেছে বলে জানান এক পুলিশ কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে ঢাকার সাবেক পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামানের (বর্তমানে রাজশাহী পুলিশ একাডেমিতে কর্মরত) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বসুন্ধরা থেকে চেক গ্রহণের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘৫ আগস্ট পরবর্তী বদলিজনিত কারণে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এ সংক্রান্ত সব অর্থ ও অ্যাকাউন্ট তৎকালীন পুলিশ সুপার আহমেদ মুয়ীদ স্যারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
সাবেক পুলিশ সুপার আহমেদ মুয়ীদ, বর্তমানে অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ওয়েলফেয়ার) পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত। এ ব্যাপারে তিনি আমার দেশকে জানান, অল্প কিছুদিন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেছেন । তাই সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজটি করতে পারেননি । পদোন্নতিজনিত বদলি হওয়ায় তিনি বর্তমান ঢাকা পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামানকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন।
বসুন্ধরা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মাকসুদুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, কেরানীগঞ্জের অপরাধ প্রবণতা কমানোর জন্য ১০ কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেনি।
এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপ ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য যে টাকা দিয়েছে, তা আত্মসাৎ হয়নি। যারা টাকা ট্রান্সফার করে আমার ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখার কথা বলছে, তা সত্য নয়। সরকারি নিয়মকানুন আছে। ইচ্ছে করলেই টাকা সরানোর সুযোগ থাকে না। তাছাড়া সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল। কিছু অনিয়ম দেখা দেওয়ায় নোটিস দিয়ে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। আমি কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম করিনি।
তাহলে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের টাকা কোথায় আছে—জানতে চাইলে আনিসুজ্জামান বলেন, আগে যে ব্যাংকে টাকা জমা ছিল, জটিলতার আশঙ্কায় সে ব্যাংক থেকে সরিয়ে ঢাকা ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে রাখা হয়েছে।তবে পুলিশের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, তিনি নিজের নামে একাউন্ট খুলে সেখানে টাকা হস্তান্তর করেছেন।তার বিরুদ্ধে রেকার-বাণিজ্য, বদলিবাণিজ্য ও টাকার বিনিময়ে বিসিএসএ উত্তীর্ণ হওয়ার কথাও অস্বীকার করেন তিনি।
Mytv Online